Monday, January 27, 2025

10>aith 46>||তন্ত্র আর কিছু কথা ||(1+2)

  10>aith 46>||তন্ত্র আর কিছু কথা  ||(1+2)

           Part (1)

            <-----আদ্যনাথ----->

 সেদিন দেখলাম এক সাধু সাধনায় বিভোর। 

মধ্যপ্রদেশের  এমন শুষ্ক জঙ্গলে 

যেখানে শুধুই পলাশ ও মহুয়ার জঙ্গল ,

কাছে ধারে অন্তত 5/7 মাইলের মধ্যে কোন জনবসতি নাই। জঙ্গলে তেমন কোন ফলের গাছও নাই কেবল দুই একটি আমলকি গাছ দেখাযায় তাও সংখ্যায় অতি কম।

এমন জায়গাতে ধ্যানমগ্ন সাধুকে দেখে বেশ অবাক হলাম। 

আমি জিপ নিয়ে যাচ্ছিলাম চম্পা থেকে বিলাসপুরের দিকে ।

ইচ্ছা হোল ওই জঙ্গলের ভিতরের মন্দিরটা একটু দেখে যাই, বহুদিন আগে একবার এসেছিলাম তাই ইচ্ছা হোল,  জিপ ঘুরিয়ে দিলাম জঙ্গলের দিকে  হঠাৎ দেখি ওই মন্দিরের একটু আগেই পাকদন্ডির ধারে জঙ্গলের মধ্যে একটি ঢিবির উপরে বসে আছেন এক সাধু। ইচ্ছা হোল একটু কথা বলি কিন্তু প্রায় আধা ঘন্টা দাঁড়িয়েও সাধুর ধ্যান ভাঙলো না। অগত্যা আজকের মতন মনের ইচ্ছা মনে চেপে রেখে রওনা দিলাম। আরএকটু এগিয়ে গিয়েই সেই মন্দিরটি  দেখলাম।

এমন সুন্দর কারুকার্য করা মন্দির  ভিতরে কোন দেবতা আছে জানিনা কারন আজও দেখলাম মন্দিরের গেট বন্ধ।

তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কোন শিব মন্দিরই হবে।

তবে মন্দিরটির সম্পুর্ন দেওয়ালে সেই পুরীর মন্দিরের মতন স্ত্রী-পুরুষের যৌনমিলনের মূর্তি । 

গ্রামটির নাম ভুলে গেছি তবে মবেহয় ছিন্নর।

একটু দাঁড়ালাম যদি কোন মানুষের দেখা পাই তো মন্দিরটির বিষয়ে যদি কিছু জানতে পারি।

এই জঙ্গলের আমাদের ক্যাম্প আছে দুইটি  সেও অনেক দূরে দূরে।

আমি ড্রিলিং এর কোর সেম্পেল নিয়ে যাচ্ছিলাম বিলাসপুরের  অফিসে ।



(আমি যে ছিন্নর গ্রামের কথা বলছি  সেটি

কিন্তু মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট জেলার চিন্নর  জেলা জিআই ট্যাগ পাওয়া চিন্নর নয়।

চিন্নর বিখ্যাত এক প্রকার চালের জন্য।

 এটি একটি স্বাদু, মিষ্টি, এবং সামান্য আঠালো চাল। রান্নার পরেও এটি জল ধরে রাখে। চিন্নর চাল থেকে তৈরি খির বালাঘাটের মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয়। )


কিন্তু সেই সাধুর তাঁর ধ্যান থেকে জাগলেন না। 

আমার কোরস্যাম্পেল গুলি অফিসে পৌঁছতে হবে তাই একটু তারা আছে।

সেই কারণে আর অপেক্ষা না করে চলেগেলাম।

কিন্তু মনে একটু খটকা লাগলো ঐসাধুর জন্য । তাই ফেরার পথে তখন সন্ধ্যে 6টা হবে জঙ্গলে অন্ধকার নেমে আসছে, আমি আবার গেলাম ওই সাধুকে দেখতে। গিয়ে দেখি সাধু কিছু কাঠ কুড়োচ্ছেন। আমি আযাচক হয়ে ওনাকে কাঠ কুড়োতে একটু সাহায্য করলাম। সাধু আমাকে আশীর্বাদ করলেন। আমি কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতেই উনি মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বললেন। আমি অবাক হয়ে চুপ থাকলাম।

তারপরে সাধুটি ইশারায় আমাকে ওনার সাথে যেতে বললেন। আমি ওনার কথামতন ওনার পিছু পিছু এগিয়ে চললাম।

জঙ্গলের ভিতর গিয়ে দেখি ছোট্ট একটি কুঠি , সাধু কুঠিরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে একটি কাঠি দিয়ে মেখেতে হিন্দিতে লিখলেন।

"अभी तुम निकल जाओ। 

बादमे भेट करना अमरकंटक में।"

এমন কথা লিখেই উনি আমাকে যেন তাড়িয়ে দিতে পারলেই বাঁচে, এমন ভাব করে প্রায় দূর দূর করে আমাকে তাড়িয়েই দিয়ে ছিলো সেদিন।

এর কিছু দিন পরে আমি গিয়েছিলাম এমরকন্টকে সেই সাধুর খোঁজ করতে।

এর আগেও আমি অমর কন্টকে এসেছিলাম তাই কিছু মানুষ ও সাধুর সাথে পরিচয় আছে।

আমি সকলকেই ওই সাধুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে কোন খবর পেলাম না।

সেবার আমি ছয় দিন ছিলাম অমর কন্টকে, তৃতীয় দিনে গেলাম

নর্মদা মন্দির থেকে 4-5 কিলোমিটার দূরে শোনমূঢ়াতে।

এখানে শোন ও ভদ্র  নদীর উত্‍পত্তিস্থলে গড়ে উঠেছে দেবী শোনাক্ষীর মন্দির, যা একান্ন সতীপীঠের অন্যতম পীঠ। 

ব্রহ্মার মানস পুত্র শোন।ব্রহ্মার চোখের জল থেকেই শোন নদীর উৎপত্তি।

শোনের উদ্‌গম স্থলের অনতিদূরে ভদ্র নদীর উৎস স্থান। এখান থেকেই শোন ও ভদ্র এক হয়ে জল প্রপাতের সৃষ্টি করেছে। সেই প্রপাত দেখবার মতো। এরপর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে শোন বিহার প্রদেশে শোনপুরে গিয়ে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে।

এখানে শোন ভদ্র কুণ্ডের  কাছে যেতেই দেখা হোল সেই সাধুর সঙ্গে।

আমাকে দেখেই সাধু একটু হেসে বললো 'কি মনে পড়েছে?"

আমি ওনার মুখে বাংলা কথা শুনে খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। উনি নিজেই বললেন কি হোল! আরে আমি বাংলা জানি। 

আয় আমার কুঠিতে আয়, এইবলে উনি আমাকে যে কুঠিতে নিয়ে গেলেন সেই কুঠি আমার চেনা।

আমি বললাম বাবা এখানে তো একদন্ডী বাবা থাকতেন! 

সাধু বললেন হ্যাঁ গুরুজী নাসিক গেছেন কুম্ভ স্নানে এখনো ফেরেরনি , উনি ফিরলেই আমি যাবো হরিদ্বার।

এই স্থানেই আমার সাধনার স্থান।

এখানেই আমি শবসাধনা কিরেছি গুরুজীর উপস্থিতিতে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে শবসাধনা সেতো তাড়াপীঠে হয় দেখেছি।

মরা লাশের পিঠে ত্রিশূল পুঁতে যজ্ঞ কুন্ড জ্বালিয়ে। রাত ভর সেকি কান্ড।

সেবার এমন সাধনা দেখে ভিষিন অবাক হয়েছিলাম। তা এই এমরকন্টকেও শবসাধনা হয় জানতাম না।

সাধু বললেন হ্যাঁ শবসাধনা ভীষণ কঠিন সাধনা। অমরকন্টের এই শোনমূঢ়ার

দেবী শোনাক্ষীর মন্দির, যা এক সতিপিঠ।

আর সতিপিঠ মানেই সিদ্ধ স্থান।

এখানে সকল সাধনার উৎকৃষ্ট স্থান।

আমি বেশ উৎসাহ অনুভব করলাম এবং শবসাধনার বিষয়ে জানবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম সাধু মহারাজের কাছে (ওনার নাম সিদ্ধান্তনন্দ)। এর পরে আরও তিন দিন ওই শোনমূঢ়ায় থেকে সাধুজীর কাছে 

তন্ত্র সাধনার অনেক কথাই জেনেছিলাম।

আজ সেই সাধু কাছে শোনা তন্ত্র সাধনা নিয়েই লিখছি--------(যেটুকু যা বুঝতে পেরেছিলাম ও যা কিছু মনে আছে )

শুরু কিরেছি  "শব সাধনা" নিয়ে কিছু লিখতে------


  "সাহসে যে দুঃখদৈন্য চায়

   মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে।

    কালনৃত্য করে উপভোগ

    মাতৃরূপা তারি কাছে আসে ।"

                  ( বিবেকানন্দ)

এমন কথাই তন্ত্রের মূল কথা ।

সাধুজীর কথায় কালী,করালিনীর উপাসনা , ভীমার পূজা, রুদ্রানীর আবাহন

প্রভৃতি----দুর্বল হৃদয়ে কাজ নয়।

সাহসী শক্তিমানের একান্ত আত্মবিশ্বাসের 

উপর নির্ভর করে অসীম সাহসেরসঙ্গে এই সাধনা করতে হয়।

আসলে অমোঘবীর্যে প্রতিষ্ঠা যে সাধনা সেখানে হৃদয়ের সকল বাসনা, কামনাকে নির্মূল করে সাধকের হৃদয়কে শ্মশান করে তোলে এবং সেই উন্মুক্ত হৃদয়ে মহা আনন্দে সর্বসুন্দরের অধিকারী  শ্যামাসুন্দরীর নৃত্য হবে। আর এভাবেই তন্ত্র সাধনা হয়।


তন্ত্র সম্বন্ধে বলা হয়---

" তন্ত্র" শব্দটি ( 'তন্' ধাতু নিষ্পন্ন যার অর্থ 'বিস্তার')

তন্ ধাতুর উত্তর উনাদি প্রত্যয় ষ্ট্রন্ প্রয়োগ করে ব্যুৎপন্ন হয়েছে। তন্' ধাতুর অর্থ 'বিস্তার'। 

বিশেষ বিশেষ পন্ডির যাঁরা তন্ত্র সাধনা বিষয়ে  জ্ঞান রাখেন যেমন বাচস্পতি, আনন্দগিরি এনদের  মতে তন্ত্রি ধাতু থেকে তন্ত্র শব্দ ব্যুৎপন্ন। তন্ত্রি ধাতুর অর্থ ব্যুৎপাদন বা জ্ঞান। 

এভাবেই দেখা যায় যে তন্ত্রি ধাতুরও অর্থ বিস্তার রূপে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। 

সুতরাং তন্ত্র শব্দের দ্বারা যে কোন বিস্তারিত আলোচনা বুঝানো যায়।



সেইজন্য দেখা যায় প্ৰাচীন কালে যাগ, যজ্ঞ, ক্রিয়া, তত্ত্ব, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় বুঝানোর জন্য তন্ত্র শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।

এভাবেই সংখ্যা দর্শনের গ্রন্থাদির নাম ছিল 

ষষ্টিতন্ত্রশাস্ত্র, ন্যায়তন্ত্র,ধর্মতন্ত্র,ব্রহ্মতন্ত্র,

যোগতন্ত্র,আয়ুর্বেদতন্ত্র প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়।

কিন্তু কালক্রমে তন্ত্র শব্দের সঙ্কীর্ণতর ক্ষেত্রে প্রয়োগ দেখা যায়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে তন্ত্রের(4 )চারটি অংশ::---

●1>জ্ঞান--- অর্থাৎ দার্শনিক মতবাদ, 

বীজাদির শক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান, মন্ত্রশাস্ত্র।

●2> যোগ----অর্থাৎ ধ্যানধারণাদির বর্ণন ও বিবিধ সিদ্ধিলাভের জন্য মায়াযোগ।

●3>ক্রিয়া---মূর্তি--মন্দিরাদির 

নির্মাণবিষয়ক  আলোচনা এবং

●4>চর্যা---- অর্থাৎ আচার-- ব্যবহার, উৎসব ব্রত  প্রভৃতির  আলোচনা।


এ-হেন আলোচনা থেকে অতি সহজেই বোঝাযায় যে তন্ত্রশাস্ত্র এক বিশাল সমন্বয় - প্রচেষ্টা। 

"বহু ভাবধারার প্রবাহ ভারতের জীবনে বিভিন্ন অববাহিকাকে অবলম্বন করে এসেছিল। তারই সমীকরণের ফল তন্ত্রশাস্ত্র।"

এমনটাও জানা যায় যে -----

"বেদের কর্মকান্ড ,মীমাংসা,বেদান্ত, সংখ্যা,

যোগ , বৈষ্ণব মতবাদ, চরক ও সুশ্রুতের চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি সকল কিছুই তন্ত্রের মতবাদের অঙ্গরূপে তন্ত্রের মধ্যে বর্তমান।"


এছাড়াও তন্ত্র শাস্ত্রের বিশেষ অংশ যা 

বামাচার নামে প্রখ্যাত তা আর্য ও অনার্য ভাবধারার সংমিশ্রণ।


[[[  তন্ত্র শাস্ত্রের ইতিহাস খুঁজতে গেলে 

পাওয়ায় যে----

 বিবেকানন্দ সহ বহু মনীষীদের মতে 

বৌদ্ধরাই তন্ত্রের শ্রষ্টা।

এক সময়ে ভগবান তথাগতর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্ঘে নারীজাতির স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কঠিন বিধিনিষেধের দ্বারা সঙ্ঘে স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশাকে নিয়ন্ত্রিতও করেছিলেন।

তথাপি সময়ে নানা জাতিসমূহের অনৈতিক প্রথার সংমিশ্রনে নানা মতের উদ্ভব ও স্ত্রী --পুরুষের সাহচর্যে  নিশাকালে নানারূপ গুহ্যসাধনার ব্যবস্থা করা হয়।

এভাবেই বৌদ্ধগ্রন্থ গুহ্যসমাজতন্ত্রে বামাচার তন্ত্রের সৃষ্টি হয়।

প্রজ্ঞাভিষেকে এর উল্লেখ আছে।

প্রজ্ঞাভিষেকের মূলকথা শক্তিগ্রহণ।

গুরু, শিষ্যের অভিলষীতা,সুন্দরী ,

যোগপারদর্শিনী শক্তির সঙ্গে শিষ্যকে মিলিত করবেন। এই বিদ্যাগ্রহণ বা 

শক্তিগ্রহণ ব্যতিরেকে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির অন্য উপায় নাই। এই শক্তি আপরিত্যাজ্যা।

এই শক্তিগ্রহণের নাম বিদ্যাব্রত।

এরপরে যখন বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে হিন্দুধবর্মের সঙ্গে মিলিত হয় তখন সকল বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচার সনুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অনুপ্ৰবিষ্ট হয়ে হিন্দুতন্ত্রের  সৃষ্টি হয়।

হিন্দুতন্ত্র  যে বৌদ্ধোত্তর এবং বৌদ্ধতন্ত্র থেকে উদ্ভূত তা বহু মনীষী স্বীকার করেছেন।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন 

" আমার বিশ্বাস আমাদের মধ্যে প্রচলিত তন্ত্রের সৃষ্টি বৌদ্ধরাই করেছে।"

আসলে তন্ত্র হোল সমন্বয়-শাস্ত্র এবং এর যা পরমতত্ত্ব তা অদ্বৈত বেদান্তের তত্ত্ব থেকেই গ্রহীত।

তন্ত্রমতে নির্গুণ ব্রহ্মই মায়াসংযুক্ত হয়ে জগতের সৃষ্টি করেন। কিন্তু বেদান্তের মায়া 

"সদসদভ্যামনির্বচনীয়া"।

আর তন্ত্রের মায়া ব্রহ্মের সহিত অভিন্ন এবং সদ্রূপা। সুতরাং বেদান্তের জগৎ যে-অর্থে মিথ্যা তন্ত্রের জগৎ সেই অর্থে মিথ্যা নয়। ]]]

   <-------আদ্যনাথ রায় চৌধুরী-------->

============================

  তন্ত্র আর কিছু কথা  ||(2)

           Part (2)

            <-----আদ্যনাথ----->

★আসল কথা হোল শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের অবলম্বন করে শাক্ত মতবাদ এবং শক্তির পূজা প্রতিষ্ঠিত।

বলাহয় সাধকের হিতের জন্যই ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করা হয়। 

বাংলার তন্ত্রসাধক  কালীর সাধক ।

কালীর উপাসনা  বাঙালির একান্ত নিজের প্রাণের উপাসনা। তাইতো কালী মুর্তিকল্পনায় স্বয়ং শিব- শবরূপে কল্পনা----এ-হেন শিবতত্ত্ব--শিব যিনি অহম্ বোধে মগ্ন। আর মহাকালী--

--তিনি--শক্তিতত্ত্ব-- তিনি সর্বদা ক্রিয়াশীল

-- ক্রিয়াশক্তি--সৃষ্ট্যুন্মুখী--অর্থাৎ সৃষ্টির তরে উন্মুখ। তাঁর অন্তরে সৃষ্টির বীজ রয়েছে। অন্যান্য দেবীমূর্তির কল্পনাতেও এই শিব--শক্তিতত্বেরই প্রকাশ।

এই শক্তি তত্ত্ব এর মূলেও রয়েছে বেদ।

কারণ ঋগ্বেদের  দশম- মন্ডলে দেবী সূক্তে বলা আছে ---"আমার দ্বারাই লোক জীবিত আছে। অন্নগ্রহণ ও শ্রবণাদিও করছে।

আমাকে যে অবহেলা করে সে বিনষ্ট হয়। 

তুমি শ্রদ্ধাবান । এইজন্য তোমাকে বলছি।

দেবী ভগবতী মহামায়ার পূজা বাহ্যিক ও হতেপারে বা অন্তর ধ্যানজপাদিও হতে পারে।  

দেবীর গূঢ় রহস্য ব্যাখ্যা করা সে এক বিশাল কঠিন ব্যাপার ।দেবীর মন্ত্রাদির যে তত্ত্ব তাও ব্যাখ্যা করা অতি দুরূঢ় ব্যাপার, যা এই ছোট অবসরে সম্ভব নয়।

          

তবে এইটুকু আমাদের অবশ্যই জেনে রাখতে হবে যে দেবীর বাহ্যিকপূজার

আরালে  এবং বিভিন্ন মন্ত্রাদির ব্যবহারে সচেতন বিন্দু ,নাদ,ও বীজামন্ত্র অবলম্বন করে একটি বিরাট দার্শনিক পটভূমিকা আছে।

●মন্ত্র তন্ত্রের মন্ত্র সকল  নিরর্থক শব্দমাত্রই নয়।

তন্ত্র বলে যে, মানব দেহভান্ড ব্রহ্মাণ্ডেরই প্রতিরূপ। এই দেহে শিব-শক্তি আছেন।

পরম শিব সহস্রারে এবং শক্তি কুন্ডলিনীরূপে  মূলাধারে। অবরোহক্রমে।

এই জগতের সৃষ্টি।

অবরোহক্রমে সাধক কুন্ডলিনীর সঙ্গে পরম শিবের মিলন করতে পারলেই মোক্ষ লাভ হয়। এই মিলনসাধনের জন্য তন্ত্রে পূজা, ধ্যান, মন্ত্রজপ,হোম, দীক্ষা প্রভৃতি নির্দিষ্ট হয়েছে।

এই বিষয়ে আর একটি বিষয়ের হল;--

তন্ত্র আর্য ও আর্যেতর ভাবধারার সংমিশ্রণ।

এর ফলে তন্ত্রের মধ্যে বৈদিক ও অবৈদিক আচার মিশ্রিতভাবে আছে। তন্ত্রে সাধকের জন্য যেসকল আচার  নির্দিষ্ট আছে তা বিশেষ তন্ত্রের মতে সাতটি---

1>● বেদচার, 

2>●বৈষ্ণবাচার,

3>●শৈবাচার,

4>●দক্ষিণাচার,

5>●বামাচার,

6>●সিদ্ধান্তাচার,

7>●কৌলাচার।

এগুলির মধ্যে প্রথম চারটি অর্থাৎ

বেদচার, বৈষ্ণবাচার,শৈবাচার,দক্ষিণাচার,

এরা বেদপর এবং শেষ তিনটি--

বামাচার,সিদ্ধান্তাচার,কৌলাচার, এগুলির

আচার অবৈদিক ভাবপূর্ন।

সাধারনত প্রথম চারটি আচার হিন্দুধর্মের -- মর্মে মর্মে অনুপ্ৰবিষ্ট হয়ে বাঙালীর ধর্মসাধনাকে প্রাণবন্ত করেছে। তত্ত্বের সঙ্গে ক্রিয়ার সহযোগে একটি সাধনার সহজ পথের আবিষ্কার করেছে।

বাঙালী জাতির পূজা দীক্ষা, ব্রত, নিয়ম প্রভৃতি সকল বিষয়ই তন্ত্রের এইসকল আচার দ্বারা পরিচালিত।

কিন্তু বামাচার প্রভৃতি ---যা গোপনে অনুশিষ্ঠ প্ৰক্রিয়াদির সহযোগে অনুষ্ঠিত

হয়--তা অনৈতিক ভিত্তিভূমির উপরে আস্তৃত (বিস্তৃত বা প্রসারিত)। এইসকল আচারে পঞ্চমকারের অনুষ্ঠানে মদ্য,মাংস,মৎস্য, মুদ্রা, এবং স্বকীয়া বা পরকীয়া স্ত্রীগ্রহণ করা হয়।

অবশ্য তন্ত্রে অধিকারভেদে  তিনটি ভাবকে আশ্রয় করার কথা আছে।

★দিব্যভাব, ★<বীরভাব, ★পশুভাব।

দিব্যভাবের যাঁরা মানুষ তাঁরা উচ্চস্তরের লোক। 

তাঁদের পক্ষে মদ্য অর্থে সহস্রার ক্ষরিত সুধাধারা, 

কাম ক্রোধ প্রভৃতি রিপুকে ছেদনপূর্বক নির্বিষয়তালাভই মাংসগ্রহণ, 

অহঙ্কার দম্ভ প্রভৃতিকে বশীভূত করাই মৎসভক্ষণ, 

আশা তৃষ্ণা প্রভৃতি অষ্টমুদ্রাকে দমন করাই মুদ্রা গ্রহণ এবং 

ইড়াপিঙ্গলা- বাহিত বায়ুর সুষুম্নাতে সংযোগই স্ত্রীগ্রহণ ।


যাঁরা পশু ভাবে-- স্থিত তাঁদের পক্ষে সম্বিদা, গুঁড়ার্দ্রক প্রভৃতি মদ্যের অনুকল্প, 

লবনার্দ্রক  মাংসানুকল্প, 

লবণতৈলাক্ত দগ্ধকুষ্মান্ড মৎসানুকল্প, ঘৃতে ভর্জিত মুগ প্রভৃতি বীজ মুদ্রাকল্প এবং রক্তচন্দনানুলিপ্ত অপরাজিতা এবং করবী পুষ্পের সংযোগেই পঞ্চম মকারানুকল্প।


বীরভাবে কিন্তু মুখ্য পঞ্চতত্ত্বের ব্যবহার আবশ্যিক এবং বামাচারীদের মতে কলিযুগে পশুভাব প্রতিষিদ্ধ । 

কাজেই যেহেতু দিব্যভাবের সাধক দুষ্প্রাপ্য সেই জন্য অধিকাংশ তান্ত্রীকেরই বীরভাবে মুখ্য পঞ্চতত্ত্ব গ্রহণ করেই সাধন করা উচিত---বামাচারীদের মতে। 


এই কারনেই বামাচার বাংলার সমাজে গভীরভাবে আত্মপ্রবেশ করেছে। 


বীরভাবের বামাচার  সাধবের অবশ্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমি আছে। যেসকল লোক সহজাত প্ৰবৃত্তির অবদমনহেতু মানষিক - আপচারসম্পন্ন

(Psycho-pathological) তাদের মানবগ্রন্থির মোচনের জন্য বা সংস্কারের উদ্গতির জন্য বীরভাবের সাধনা ফলদায়ক হতে পারে। 


ভোগের পথে মানুষের মনকে ধীরে ধীরে কিভাবে ঈশ্বরাভিমুখী করা যায় সেই অসাধ্য সাধনেই বীরভাবের প্রচেষ্টা। রূপরস মুগ্ধ অস্বাভাবিক মনোবিশিষ্ঠ  মানুষকে সাহায্য করাই বীরভাবের উদ্দেশ্য। 


সুস্থিমনঃসম্পন্ন  স্বাভাবিকবৃত্তিবিশিষ্ট  মানবের জন্য কিন্তু এপথ নয়। এপথে  

শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের কথায় --"পায়খানার পথ"। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন ::--

"যে জঘন্য বামাচার তোমাদের দেশকে নষ্ট করে ফেলেছে অবিলম্বে তা ত্যাগ কর । তোমরা ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান দেখেনি। দেশের পূর্বসঞ্চিত জ্ঞানের যতই বড়াই কর না কেন, যখন আমি দেখি আমাদের সমাজে বামাচার কী ভয়ানকরূপে প্রবেশ করছে, তখন উহা আমার অতি  ঘৃণিত নরকতুল্য স্থান বলে বোধ হয়।

এই বামাচার সম্প্রদায় আমাদের বাংলাদেশের সমাজকে ছেয়ে ফেলেছে আর রাত্রে বীভৎস ব্যাভিচারে লিপ্ত থাকে তারাই দিনেরবেলা উচ্চকন্ঠে আচারের কথা বলে ।"


সুতরাং এই বামাচার প্রভৃতি কুৎসিত ব্যাপার সযত্নে পরিহার করে তন্ত্রের মধ্যে যাকিছু ভালো জিনিষ আছে তা গ্রহণ করতে হবে। তন্ত্রের সবচেয়ে বড় কথা  মাতৃভাবে দেবীর উপাসনা এবং এই উপাসনা করতে হবে নির্ভয় হয়ে। অভয়প্রতিষ্ঠ সাধকই যথার্থ বীরসাধক।

মদ্য মাংসাদিসেবী তথাকথিত 

বীরভাবালম্বী বীরসাধক নয়। এই বীরসাধক ছিলেন বীরেশ্বর বিবেকানন্দ যিনি ভীষণকে ভিষনতার জন্যই পূজা করতে চেয়েছিলেন, যিনি উপদেশ করেছিলেন তাঁর শিষ্যকে যে, যখন মায়ের কাছে প্রার্থনা জবাবে তখন "মনে রেখো তিনি যেন তোমার প্রার্থনা শুনতে বাধ্য হন। মায়ের কাছে  কোন আর্তভাব যেন প্রকাশ না পায়। স্মরণ রেখো।" 


সত্য এই তো যথার্থ বীরভাবের কথা।

আমরা নানান স্থানে নানা ভাবে মায়ের পূজা করি। কিন্তু প্রকৃত ফল কিছু পাই কি?  

অঙ্গহীন হলে বা শ্রদ্ধার  অভাব হলে পূজার ফলাফল হয় না, বিপরীত ফলও ঘটতে পারে। কজেই ঠিক ভাবে পূজা 

করাই উচিত আর এই সঠিক ভাবে  পূজা

করতে হলে অভয়প্রতিষ্ঠি হয়েই করতে হবে। আর তখনই মায়ের অমোঘ আশীর্বাদ আমাদের শিরে বর্ষিত হবে।

স্বামী সারদানন্দের "ভারতে শক্তিপূজা" থেকে এই বিষয়ে একটু তুলে ধরেই আমি আমার লেখা শেষ করছি:-------

  " অন্য দেশে মা শত হস্তে ধনধান্য ঢালিয়া  দিতেছেন। দেখিয়া ঈর্ষায় তোমার অন্তস্থল জ্বলিয়া উঠে। তাহাদের হৃষ্ট-পুষ্ট  সন্তানসকলের প্রফুল্ল মুখকমলের সহিত  ক্ষুৎক্ষামকণ্ঠ, আচ্ছাদনবিরহিত, রোগে জর্জরিত তোমর সন্তানসকলের তুলনা করিয়া তুমি জগদম্বাকেই শত দোষে দোষী কর। অন্যের পদঘাতপীড়িত  হইয়া তুমি অদৃষ্টকে শতবার ধিক্কার দিয়ে থাক--- কিন্তু দোষ কার?

দেখিতেছ না , তাহারা অজ্ঞান সমরে সামর্থ প্রকাশ করিয়াই বড় হইয়াছে--- আর তুমি সহস্র বৎসর অজ্ঞানকে হৃদয়ে অতি যত্নে পোষণ করিয়া নীরবে , নিশ্চিন্ত আছ?  উহারা বিদ্যরূপিনী শক্তির পূজার অদম্য উৎসাহে কষ্ট সহিয়াছে , অজস্র হৃদয়ের রুধির ব্যায় করিয়াছে, দশের  কল্যাণের জন্য আত্মবলি দিয়া দেবীকে প্রসন্ন করিয়াছে-- আর তুমি অবিদ্যাসেবায় যথাসর্বস্ব পণ করিয়া ক্ষুদ্র স্বার্থসুখ লইয়া বসিয়া আছ। জগন্মাতা তোমায় দিবেন কেন? 

শাস্ত্র যে তোমায় বারবার বলিতেছেন, তিনি বলিপ্রিয়া, রুধির প্রিয়া। দেবীর ঐ ভাব যে তাঁহার ধ্যানমন্ত্রে রহিয়াছে। ঐ শুন, ভারতের তন্ত্রকার তোমায় কি ভাবে শক্তির ধ্যান করিতে বলিতেছেন---


"ওঁ শবারুঢ়াং মহাভীমাং ঘোরদংস্ট্রাং বরপ্রদাম্।

হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্ত্তৃকাকরাম্।।

মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহু। 

চতুর্ব্বাহুযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ।।"

প্রতিকার্যে  মহাশ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া স্বার্থসূখ ত্যাগ , আত্মবলিদানে তাঁহার তর্পণ কর। তাঁহাকে প্রশ্ননা কর, দেখিবে শক্তিরূপিনী জগদম্বা  তোমার প্রতি ফিরিয়া চাহিবেন। তোমার নয়নে দীপ্তি, বাহুতে বল, হৃদয়ে তেজ, অন্তরে অদম্য উৎসাহরূপে প্রকাশিত হইবেন। দেখিবে  জগন্মাতার নিত্য সহচরীদল---বুদ্ধি, লজ্জা,ধৃতি, মেধা, প্রভৃতি -- আবার তোমার উপর প্রসন্না হইয়া প্রতি কার্যে তোমার সহায়তা 

করিবেন।"

 <-------আদ্যনাথ রায় চৌধুরী-------->

============================


Friday, January 24, 2025

9>aith 43>পঞ্চ ম-কার ও,::আগম,নিগম,তন্ত্র ।(1+)

  43>পঞ্চ ম-কার ও,::আগম,নিগম,তন্ত্র ।

43/1>||  বামাচার উপাসনা ||

===============================

43>পঞ্চ ম-কার ও,::আগম,নিগম,তন্ত্র ।

               (সংগৃহীত)

তন্ত্রশাস্ত্রে পঞ্চ ম-কার সাধনার উল্লেখ আছে।

পঞ্চ ম-কার অর্থাৎ পাঁচটি দ্রব্যের আদ্য অক্ষর "ম"। যথা মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্র, ও মৈথুন এই পাঁচটিকে এক কথায় পঞ্চ ম-কার বলে।

পঞ্চ ম-কারের সাধন ফলও অসীম।

  "মদ্যং মাংসং তথা মৎস্যং মুদ্রা   

   মৈথুনমেব চ।

 ম-কারপঞ্চকং কৃত্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।।"

পঞ্চ-মকার- সাধকের পুনর্জন্ম হয় না।

"পঞ্চমে পঞ্চমাকারঃ পঞ্চাননসমো ভাবেৎ" ।

পঞ্চ ম-কার সাধনায় সিদ্ধ সাধক শিব তুল্য হন।

■■

ষটচক্র, বিশেষ্য।

দেহাভ্যন্তরস্থ সুষুম্না নাড়ীর মধ্যবর্ত্তী অতি সূক্ষ্ম পদ্মাকৃতি ছয়টি চক্র। মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা- এই ছয়টি চক্র। সকলের উর্দ্ধে সহস্রার পদ্ম।■■■■

পঞ্চ ম-কার আসলে পাঁচ উপচার, পাঁচ অঙ্গ বিশিষ্ট মাতৃকা উপাসনা, এবং জগন্মাতার আবাহন করতে পাঁচটি রিচুয়াল বা আচার হিসেবেই এর তাৎপর্য। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন – এই পাঁচটি হল পঞ্চ ম-কার। নামগুলোর স্থূল অর্থ স্পষ্ট, কাউকে বোঝাতে হবে না।

সাধারণে এই সাধনার প্রকৃত গুহ্য অর্থ বুঝতে না পেরে এই তত্ত্ব সম্বন্ধে নানা কথা বলে থাকেন।

আসলে কিছু অসৎ মানুষ মন্ত্র তন্তের নামে  মদ্যপান, মাংসভোজন, মৈথুনের অপব্যহার তথা বিক্রীত কুরুচি পূর্ন ব্যবহারে  বিশেষ মনযোগী হন। আর এভাবেই তারা লোভ ও লালসায় আকৃষ্ট হয়ে ক্রমবর্ধমান ব্যভিচারে জীবন অতিবাহিত করেণ ও সাধারণ মানুষকে ভুল পথে পরিচালনা করেন।

ফলে সাধারণ মানুষের মনে তন্ত্রশাস্ত্রের প্রতি  অশ্রদ্ধা  তৈরি হয়।

কিছু মানুষ তো তান্ত্রিকের নাম শুনলেই যেন ভয়ে শিহরিত হন।

আসলে কিছু মানুষ তন্ত্র সাধনার নামে আড়ালে ব্যাভিচার করতেই অভ্যস্থ।

কিন্তু প্রকৃত অর্থে মদ্য,মাংস,মৎস,মুদ্র, ও মৈথুন এই পাঁচটির প্রকৃত অর্থ নিম্ন রূপ::---

★মদ্য::--

(নির্বিকার নিরঞ্জন পরব্রহ্মতে যোগ সাধন দ্বারা যে প্রমদ-জ্ঞান, তাহার নাম মদ্য)

প্রকৃত তন্ত্রের সূক্ষ্ম মতে মদ্য অর্থ হোল--:

ধ্যানের বিশেষ ক্রিয়ার মাধ্যমে যখন ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে অমৃত ধারা ক্ষরিত হয়, সেই অমৃত ধারা পান করিলে সাধক আনন্দময় হইয়া ওঠে। আর ইহাকেই বলা হয় মদ্য-সাধন।

★মাংস::---

(যে সব সৎকৃত কর্ম নিষ্কল পরব্রহ্মে  সমর্পণ করে, সেই কর্মসমর্পণের নাম মাংস।)

আবার সূক্ষ্ম তন্ত্র মতে মা রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশসম্ভুত, যে সাধক উহা ভক্ষণ করে , তাহাকেই মাংস-সাধক বলা হয়।

মাংস-সাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে 

বাক্যসংযমী ---মৌনাবলম্বী যোগী।

★মৎস::---

(সর্বভূতে আমার ন্যায় সুখ-দুঃখ সমজ্ঞান এই যে সাত্ত্বিক জ্ঞান তাহার নাম মৎস্য।)

---ইড়া ও পিঙ্গলা নারীকে গঙ্গা ও যমুনা বলা হয়।

এবং শ্বাস-প্ৰশ্বাসই দুটি মৎস্য।

এই গঙ্গা যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চলিতেছে,

যে সাধক এই দুটি মৎস্য ভোজন করে তাহাকে মৎস্য-সাধক বলে।

যিনি প্রাণায়াম দ্বারা শ্বাস-প্ৰশ্বাস রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টি সাধন করেন, তাহাকেই মৎস্য-সাধক বলে।

★মুদ্রা::----

(সৎসঙ্গে মুক্তি আর অসৎসঙ্গে বন্ধন--ইহা জানিয়া অসৎসঙ্গ পরিত্যাগের নাম মুদ্রা।)

সদাশিব আদ্যাশক্তি ভগবতীকে বলিলেন 

হে দেবেশি! অর্থাৎ "দেবদের দেবী"

শিরস্থিত সহস্রদল পদ্মে মুদ্রিত 

কর্নিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ পারদতুল্য আত্মার অবস্থিত। যদিও তাহার তেজ কোটি সূর্য্যের ন্যায়, কিন্তু স্নিগ্ধতায় কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরমপদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী- শক্তিসমন্বিত

---যাহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয় তিনিই, প্রকৃত মুদ্রা- সাধক।

★মৈথুন::---

(মুলাধারস্থিত কুন্ডলিনীশক্তিকে যোগ- সাধন দ্বারা  ষট-চক্রভেদপূর্বক শিরস্থিত

সহস্রদলকমল কর্নিকান্তর্গত বিন্দুরূপ পরমশিবের সহিত সংযোগ করার নাম মৈথুন।)

---মৈথুন ব্যাপক সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত আছে।

মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইতে সুদূর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়।

সে মৈথুন কিরূপ?

কুমকুমবর্ন রেফ কুন্ডমধ্যে অবস্থিত করে, ম-কার বিন্দুরূপে মহাযোনিতে অবস্তিত।আকাররূপী হংসের আশ্রয়ে যখন ঐ উভয়ের একতা ঘটে, তখন সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়।

যে সাধক ঐ ভাবে মিলন করিতে সক্ষম তিনিই মৈথুন-সাধক।

মৈথুনে যেরূপ আলিঙ্গন, চুম্বন,শীৎকার, অনুলেপ, রমণ এবং রেতোৎসর্গ এই ছয় কৌশল বলিয়া কীর্তিতে, সেইরূপ  আধ্যান্তিক মৈথুন  প্রক্রিয়াতে ও এই প্রকার ছয়টি অঙ্গ দেখা যায়।

যোগক্রিয়ার তত্ত্ব গুলির নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন ,

আবাহনের নাম শীৎকার, 

নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, 

জপের নাম রমণ এবং 

দক্ষিনান্তের নাম রেতঃপাতন।

ষড়ঙ্গ যোগে এইরূপ ষড়ঙ্গ সাধন করার নামই মৈথুন- সাধন।

এইপ্রকারে পঞ্চ ম-কার যোগ সাধন ক্রিয়া এক বিশেষ যোগ ক্রিয়া তাতে কোন সন্দেহ নাই।

প্রকৃত পক্ষে তন্ত্র ও যোগ উভই সদাশিব কথিত।

মদ্যাদি সেবনের উদ্দেশ্যে ধর্ম নয়,

পরন্তু ধর্মের উদ্দেশ্যেই পঞ্চতত্ত্বানুষ্ঠানের

প্রয়োজনীয়তা।

মদ্যপান কালে হৃদয়ে যে ভাব পোষণ করা যায় , তাহাই উচ্ছসিত হইয়া থাকে এবং একাগ্রতায় দৃঢ় হইয়া উত্তরোত্তর সাধনার পথে অগ্রসর হয়।

সাধকের পানের জন্য সাধনা নয়,

সাধনার জন্যই পান।

সঠিক মন্ত্র পূত মদ্য পানে মদ্য তেজোধর্মী হয়, তখন উহা সাধনানুযায়ী কুন্ডলিনী শক্তির  মুখে আপতিত হইয়া কুন্ডলিনী শক্তিকে উদ্বোধিতা করে, এবং এই জন্যই সাধকের মদ্যপান।

মদ্য পান করিয়া মাতাল হওয়া অর্থ পশুরুপে গণ্য হইয়া ভ্রষ্ট  কুলধর্ম চ্যুত হওয়া।

★★>

পঞ্চমকার বা পঞ্চতত্ত্ব হলো তান্ত্রিক অনুশীলনে পাঁচটি সীমালঙ্ঘনকারী পদার্থের জন্য তান্ত্রিক শব্দ। 

এগুলো হলো মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা  ও মৈথুন ।

 উপাদানগুলি কেবল "বামপন্থ"-এর তান্ত্রিকদের (বামাচারী) দ্বারা অনুশীলন করা হয়, যেখানে "ডানপন্থ"-এর তান্ত্রিকরা (দক্ষিণাচারী) এগুলির বিরোধিতা করেন।

মহানির্বাণতন্ত্র মতে, পুরুষদের তিনটি শ্রেণি: পশু, বীর ও দিব্য। গুণের ক্রিয়াকলাপ যা এই ধরনের প্রভাব উৎপাদন করে স্থূল পদার্থের স্থলে প্রাণীর প্রবণতা প্রভাবিত করে; তিনটি প্রধান শারীরিক ক্রিয়াকলাপে উদ্ভাসিত: খাওয়া দাওয়া, যার দ্বারা অন্নময় কোষ বজায় থাকে; এবং যৌন মিলন, যার দ্বারা এটি পুনরুৎপাদন করা হয়। এই ক্রিয়াকলাপসমূহ পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চমকার -এর বিষয়, কারণ এগুলিকে অশ্লীলভাবে বলা হয় — যেমন: মদ্য (মদ), মাষ (মাংস), মৎস্য (মাছ), মুদ্রা (শুষ্ক শস্য) ও মৈথুন। সাধারণ বিবেচনায় মুদ্রার অর্থ "আচার" এবং অঙ্গভঙ্গী বা উপাসনা ও হঠযোগে দেহের অবস্থানসমূহ তবে এটি পাঁচটি উপাদানের মধ্যে একটি হিসাবে এটি ভাজা শস্য। তান্ত্রিকরা পাঁচটি উপাদানকে পঞ্চতত্ত্ব, কুলদ্রব্য, কুলতত্ত্ব ও মদের জন্য কারণবারি বা তীর্থবারির মতো বিশেষ নাম দিয়েছেন, পঞ্চম উপাদানটিকে সাধারণত "লতা-সাধন" (নারী বা শক্তি সহ সাধনা) বলা হয়। তামসিক (পশ্বাচার), রাজসিক (বীরাচার) বা দিব্যাচার বা সাত্ত্বিক সাধনার অংশ হিসাবে এই পাঁচটি উপাদানগুলির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে।

====================

★★★★>আগম ও নীগম::---

এই জগৎ মাঝে দুইটি পথ প্রশস্ত 

একটি নিবৃত্তি ও অপরটি প্রবৃত্তি।

প্রকৃত পক্ষে নিবৃত্তি -- যোগ

আর প্রবৃত্তি ---ভোগ।

আগম শাস্ত্রে পঞ্চ ম - কার নিবৃত্তির পথে,

আর মহা নির্বাণ তন্ত্র প্রভৃতির বর্ণিত স্থূল পঞ্চ ম-কার প্রবৃত্তির পথে।

আগম ও নীগম::---

"তন্ত্র" বেদের শেষাংস থেকে সৃষ্টি যাকে আগম বলে আর বেদকে নিগম বলে।

তন্ত্র::----

তন্ত্র হলো ভারতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পর প্রচলিত এক বিশেষ ধরনের উপাসনা ও সাধনপদ্ধতির নাম। "তন্ত্র" বেদের শেষাংস থেকে সৃষ্টি যাকে আগম বলে আর বেদকে নিগম বলে।

 হিন্দু, তিব্বতীয় বোন, দাও তথা জাপানের শিন্টো, বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদগুলিকে এবং পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রেশম পথে বৌদ্ধধর্মের সম্প্রসারণে তন্ত্র বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। 

তন্ত্র পরম্পরাগত মাধ্যমে যুক্ত একটি আগমশাস্ত্র। ভারতীয় পরম্পরায়, যে কোনো ব্যবস্থিত গ্রন্থ, সিদ্ধান্ত, বিধি, উপকরণ, কলাকৌশল বা কার্যপ্রণালীকেও তন্ত্র বলা হয়। 

হিন্দু ঐতিহ্যে, তন্ত্র প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত, তারপর শৈব সম্প্রদায়, ও কিছু ক্ষেত্রে বৈষ্ণব পরম্পরার সাথেও সম্পৃক্ত।  শৈব পরম্পরায় তন্ত্র গ্রন্থের বক্তা সাধারণত মহাদেব শিব, যেখানে তিনি দেবী পার্বতীর তন্ত্রসম্বন্ধীয় প্রশ্নের বিধিগত উপদেশমূলক উত্তর প্রদান করেন। বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান সম্প্রদায় তাঁদের তন্ত্র-সম্বন্ধিত নীতি, কর্মপদ্ধতি ও সাহিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ।

তন্ত্র-এর আক্ষরিক উদ্ভব মনে করা হয় এরূপে - “তনোতি ত্রায়তি তন্ত্র”।

তন্ত্রশাস্ত্রকে উত্তর-বৈদিক যুগের রচনা বলে মনে করা হয়, যার বিকাশলাভ প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগের কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল। সাহিত্যরূপে যেভাবে পুরাণ গ্রন্থকে মধ্যযুগীয় দার্শনিক-ধার্মিক রচনা হিসাবে মান্য করা হয়ে থাকে, সেভাবেই তন্ত্রশাস্ত্রে প্রাচীন আখ্যান, কাহিনি ইত্যাদির সমাবেশ রয়েছে। বিষয়বস্তুগত দৃষ্টিতে একে ধর্ম, দর্শন, সৃষ্টিরচনা শাস্ত্র, প্রাচীন বিজ্ঞান ইত্যাদির বিশ্বকোষও বলা যেতে পারে। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা তাঁদের ঔপনিবেশিকতাবাদী উদ্দেশ্যসাধনে তন্ত্রকে 'গুহ্য সাধনা' (esoteric practice) বা 'সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ' আখ্যা দিয়ে দিগভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন।  

বস্তুত তন্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা সহস্রাধিক, কিন্তু প্রধান-প্রধান তন্ত্র ৬৪টি বলা হয়ে থাকে। তন্ত্রের প্রভাব যে বিশ্বস্তরীয়, তার প্রমাণ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, তিব্বতি ইত্যাদি ধর্মের তন্ত্র-সাধনার গ্রন্থসমূহ। ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গ, বিহার ও রাজস্থান তন্ত্রের মুখ্যপীঠ ছিল।

★★★

ব্যাকরণ শাস্ত্র অনুসারে, 'তন্ত্র' শব্দটি 'তন্' ধাতু নিষ্পন্ন যার অর্থ 'বিস্তার'। শৈব সিদ্ধান্তের 'কায়িক আগম' -এ এর অর্থ দেওয়া হয়েছে — তন্যতে বিস্তার্যতে জ্ঞানম্ অনেন্, ইতি তন্ত্রম্ (সেই শাস্ত্র যার দ্বারা জ্ঞানের বিস্তার করা হয়)। তন্ত্রের নিরুক্তি ‘তন’ (বিস্তার করা) এবং ‘ত্রৈ’ (রক্ষা করা), এই দুই ধাতুর সংযোগে সিদ্ধ হয়। অর্থাৎ, তন্ত্র সামগ্রিকভাবে জ্ঞানের বিস্তার করা ছাড়াও এর ব্যবহারকারীকে 'ত্রাণ' (রক্ষা) -ও করে থাকে।

তন্ত্রশাস্ত্রের আরেক নাম 'আগমশাস্ত্র'ও বটে। এই বিষয়ে বলা হয়েছে যে,

আগমাত্ শিববক্রাত্ গতং চ গিরিজা মুখম্।

সম্মতং বাসুদেবেন আগমঃ ইতি কথ্যতে।।

বাচস্পতি মিশ্র তাঁর যোগভাষ্যের তত্ববৈশারদী ব্যাখ্যায় 'আগম' শব্দের অর্থ করতে গিয়ে লিখেছেন যে, যার দ্বারা অভ্যুদয় (লৌকিক কল্যাণ) ও নিঃশ্রেয়স (মোক্ষ) -এর উপায় বুদ্ধিগোচর হয়, তাকে 'আগম' বলা হয়।

তন্ত্র বা আগমে ব্যবহারই মুুখ্য; তন্ত্রে ক্রিয়া ও অনুষ্ঠানের প্রতি জোর দেওয়া হয়। তন্ত্রশাস্ত্রের যে সাতটি লক্ষণ রয়েছে, তাতে জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনার ব্যবহারিক বা আচরণীয় উপায়ের রূপ বর্ণিত হয়েছে। এই সাতটি লক্ষণ হল:

●সৃষ্টি

●প্রত্যয়

●দেবার্চনা

●সর্বসাধন (সিদ্ধিসমূহ প্রাপ্ত করার উপায়)

●পুরশ্চরণ (মারণ, মোহন, উচাটন ইত্যাদি ক্রিয়াসমূহ)

●ষটকর্ম (শান্তি, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচাটন ও মারণের প্রক্রিয়া) তথা,

●ধ্যান (ইষ্টদেবতার স্বরূপ একাগ্র তল্লীন মনে চিন্তন)

তন্ত্রের দৃষ্টিতে শরীর প্রধান নিমিত্ত; শরীর ছাড়া চেতনার উচ্চস্তরে পৌঁছানো যায় না। এজন্য তন্ত্রের গূঢ়ার্থ নিজ 'তন' বা দেহের মাধ্যমে আপন আত্মার 'ত্রাণ' বা উদ্ধারও বলা হয়ে থাকে। বাস্তবক্ষেত্রে, তন্ত্রসাধনায় শরীর, মন ও কায়-কলেবরের সূক্ষতম স্তরের সুসমন্বিত ব্যবহার ঘটে। তবে এটি অবশ্যই সত্য যে, তন্ত্রে শরীরকে মন, বুদ্ধি ও চেতনার সমানই প্রাধান্য দেওয়া হয়।

=========================

★★★>আগম, নিগম, তন্ত্র এবং বেদ। 

আগাম- হল "যা শিবের মুখ থেকে উদ্ভূত", 

তাই আগম তন্ত্র। এগুলো বিশেষত তামিল ও কাশ্মীর শৈব ঐতিহ্যের জ্ঞান।

স্থূল চিন্তায় আগামা হল "সাময়িক", আর নিগামা হল "বিমূর্ত" বা "উচ্চ-মাত্রিক" জ্ঞান, অর্থাৎ মূর্তিহীন, ভাবমূলক, অনবয়ব।

যেমন, আগামা প্রেসক্রিপটিভ অর্থাৎ নির্দেশ বা আদেশ এবং প্রাত্যহিক জীবনে দরকারী মৌলিক জ্ঞান, দক্ষতা এবং ক্ষমতা তৈরিতে একান্ত প্রয়োজন হয়।

অন্যদিকে, নিগম অর্থাৎ বেদ, হল ব্রহ্মবিদ্যা বা আত্মজ্ঞানের অনুসন্ধানের উপর জ্ঞান দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং তাই নির্দেশমূলক না হয়ে  এটি অনুসন্ধানমূলক হয়ে থাকে। এবং যেহেতু এটি সহিত বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা জড়িত, সেই হেতু এটি তাদের জন্য বোঝানো হয়েছে যারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অভিমুখী, ব্রাহ্মণ বা ঐতিহ্যের পণ্ডিত।

বিমূর্ত বা মূর্তিহীন, ভাবমূলক, অনবয়ব জ্ঞানের যোগ্যতা সবার থাকে না। তথাপি পুরুষার্থ সর্বদা সবার জন্য। 

নিগম প্র্দ্ধতির প্রারম্ভিক ঐতিহ্যে যজ্ঞ হল প্রাথমিক পদ্ধতি বা অনুশীলন।

বেদের অপর নাম নিগম।

আগামগুলি এমন পাঠ্যগুলি যা ধর্মীয় উপাসনার সাথে সম্পর্কিত। মন্ত্র, যন্ত্র, মন্দির এবং মূর্তি নির্মাণের পদ্ধতি এবং তাদের পূজা, আমরা বাড়িতে যে পূজা করি তা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আগামগুলিতে শেখানো হয়। বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত আগম আছে।

শাক্ত আগমকে তন্ত্র বলা হয়।

শুধু বেদকেই শ্রুতি বলা হয়।

নিগামা ('যার দ্বারা [সত্য জানা যায়] স্পষ্টভাবে')

হিন্দু শাস্ত্রে 'নিগমা' শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেহেতু সর্বোচ্চ সত্য বেদের মাধ্যমে সঠিকভাবে জানা বা বোঝা যায়, তাই তারা 'নিগম' নামে পরিচিত। আদেশের বাক্যগুলিও তাদের মধ্যে রয়েছে।

সমস্ত আপত্তির মোকাবিলা করার পরে প্রতিষ্ঠিত একটি সুনির্দিষ্ট উপসংহারকে যুক্তি বিজ্ঞানে 'নিগামা' বা 'নিগমনা'ও বলা হয়, যাকে কখনও কখনও 'নিগমা' নামেও ডাকা হয়।

আরও প্রযুক্তিগত অর্থে, 'আগামা' শব্দটি সেই সমস্ত তান্ত্রিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হয় যেখানে সদাশিব দেবীকে শিক্ষা দেন এবং সেই কাজের জন্য 'নিগম' শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

               (সংগৃহীত)

======================

   43/1>||  বামাচার উপাসনা ||

          <------আদ্যনাথ------>

বামাচার বা বামমার্গ তন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ মার্গ ।

ঠিক তেমনি বামাকালীর উপাসনাও এক গরুত্ত্বপূর্ন উপাসনা। আর তন্ত্র মতে পূজার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পঞ্চ-ম-কার।

বামাচার হল একাধিক উপচার সহযোগে পূজার এক সুপ্রাচীন প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়ার সাধনার সাথে যুক্ত পঞ্চ ম-কার আসলে পাঁচ উপচার বা পাঁচ অঙ্গ বিশিষ্ট মাতৃকা উপাসনা, এবং জগন্মাতার আবাহন করতে তথা আরাধনার সত্ত্বর সাফল্য  লাভের নিমিত্ত্বে পাঁচটি আচার হিসেবেই এর তাৎপর্য।

মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন – এই পাঁচটি হল পঞ্চ ম-কার। নামগুলোর স্থূল অর্থ সকলের নিকটই অতি সহজ ভাবে

স্পষ্ট।  কিন্তু এই পঞ্চ ক্রিয়ার সূক্ষ্ম অর্থ সন্ধানের মধ্যেই আসল তত্ব নিহিত আছে।

স্থূল অর্থের সামগ্রী সহযোগে সাধন অর্থ ভণ্ডামি ও ব্যাভিচার।সেই কারণেই বামাচারী সাধনমার্গের তাৎপর্য একটু আলোচনা করা বিশেষ প্রয়োজন।

1>◆■■◆ প্রথম তাৎপর্য:----

তন্ত্র হল ভুক্তি এবং মুক্তির সামঞ্জস্য বিধান। 

তন্ত্রে পবিত্র এবং অপবিত্রর কোন ভেদাভেদ নাই বললেই চলে।সাথে সাথে কোন প্রকার বর্ণভেদও নাই,অর্থাৎ কোন উচ্চ নিচ বিভাজন নেই, তেমনি দেহ এবং চৈতন্য তন্ত্রে পৃথক নয়। বলাহয় তন্ত্র,বস্তু এবং ভাবের সমন্বয়। সেই হেতু সর্বদা সমদৃষ্টি রাখার জন্য তন্ত্রে কতগুলি অত্যাবশ্যক অনুশীলন আছে। বামাচার হল এমন একটি অনুশীলন যেখানে নির্বাণ, ভোগ, মোক্ষমার্গ, প্রবৃত্তি,উপভোগ, আনন্দ যেখানে সাধনার অঙ্গ। 

2>◆■■◆দ্বিতীয় তাৎপর্য:-------

তন্ত্রমার্গ সোজা ও সরল মর্গ, এমনকি তন্ত্রমার্গে সংসারত্যাগ ও নয়,কোনপ্রকাদ ভেদা ভেদ নয়। সকলকে নিয়েই তন্ত্র। উঁচু নিচু বিভেদ, ব্রাহ্মণ শূদ্র বিভেদ, পবিত্র অপবিত্র বিভেদ, দেহ আত্মা বিভেদ, নারী পুরুষ বিভেদ এবং সর্ব প্রকার বৈষম্য পরিত্যাগ করার আহ্বান জানায় তন্ত্র, আর এজন্যই পঞ্চ ম-কার প্রয়োজন। তন্ত্র সাধন মনেকরে কোন প্রকার বর্ণবাদ এবং শুচিবাই বা ছুৎ বিচার নিয়ে সাধনা তন্ত্র সাধন হয় না।

3>◆■■◆ তৃতীয় তাৎপর্য:---------- বামাচার শব্দের দুটি প্রধান অর্থ। বাম অর্থাৎ বাঁদিকের পথ। দ্বিতীয়ত বামা হল আমাদের জগন্মাতা মা কালীর অন্যতম শাস্ত্রীয় নাম, এই নামটি মা তারার উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হয়। অতএব বামাচার হল কালীপথ বা তারাপথ।

কিন্তু বাঁদিক কেন? বাম শব্দের একটি অর্থ হল বিপরীত। যেমন বিধি বাম মানে বিপরীত বিধি। এই অর্থে বাম মার্গ নেগেটিভ অর্থ

 অর্থ বিভ্রান্তিও হয়। এক্ষেত্রে বামাকালীর অন্যতম তাৎপর্য হল যিনি বিভ্রান্তি দূর করে দেন। যেমন দক্ষিণাকালীর তাৎপর্য: যাঁর ভয়ে দক্ষিণদিকের অধিপতি যম পালিয়ে যান।

আবার সাংখ্যর সঙ্গে তন্ত্রের প্রাচীন যোগাযোগ আছে। সংখ্যা গণনা আদিযুগে বামদিকে হত: অঙ্কস্য বামা গতি। যেহেতু তন্ত্রর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল সংখ্যাবিজ্ঞান, সেজন্যও বাম মার্গ নাম হতে পারে।

4>◆■■◆ চতুর্থ তাৎপর্য: মা কালীর বামাচার আদি প্রস্তর যুগ থেকে, ঠিকঠাক বললে চল্লিশ হাজার বছর আগে যখন থেকে প্রথম মাতৃকা মূর্তি পাওয়া যায়, তখন থেকে প্ৰচলিত আদিম মাতৃসাধনার সুবিশাল আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য বহন করে। অনেক আদিম জাতি মাতৃকা উপাসনা করত, মাতৃধর্মের উৎসব হত। এবং যেহেতু মদ্য ও মাংস পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় আদিমকালে উৎসবে ব্যবহার করা হত, তাই অনেক গবেষক মনে করেন যে বামাচার সেই আদিম স্মৃতিবাহী।

মনে রাখতে হবে, স্থূলভাবে এই পাঁচটি ম আনন্দ, সম্পদ এবং প্রাণসৃষ্টির কারণ।

 মা আদ্যা। তিনি আদি থেকে আছেন। আমরা সুসভ্য একুশ শতকের মানুষ যেমন তাঁর সন্তান, আদিম মানুষও আদিম উপায়ে তাঁর উপাসনার সমান অধিকারী ছিল।

5>◆■■◆ পঞ্চম তাৎপর্য: অর্থাৎ স্থূল অর্থে বামাচারের প্রয়োগ তন্ত্রের বাইরে নয়, সম্পূর্ণভাবে তন্ত্র অনুমোদিত। কিন্তু সূক্ষ্ম অর্থে বামাচারের প্রয়োগ বর্তমান সভ্য সমাজে, গৃহী ব্যক্তি অনেক সহজে করতে পারেন। মা আদ্যা এবং নিত্যা। কিন্তু আমরা তাঁর সীমাবদ্ধ সন্তান, আমরা প্রাচীন প্রস্তরযুগের মত অথবা আদিম মাতৃকা উপাসক জাতিগুলোর মত অবাধ নই, কারণ সভ্যতা অগ্রসর হলে আমাদের কিছু কিছু নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়।

আর সেই কারণেই বামাচারের পঞ্চ ম-কারের সূক্ষ্ম তাৎপর্য জানা বিশেষ প্রয়োজন।

6>★★★★★ প্রথম ম-কার: সূক্ষ্ম অর্থে বামাচারে মদ্য হল সাধক যখন অতিশয় আনন্দে থাকেন, অথবা খেচরী মুদ্রা অভ্যাস করেন, তখন মুখের মধ্যে নিঃসৃত লালা। সুস্থ মানুষের মুখের মধ্যে লালা নিঃসৃত হয়েই থাকে, মুখ শুকিয়ে গেলেই সেটা চিন্তার, ডাক্তার দেখাতে হয় অনেকসময়। কাজেই এইভাবে প্রথম ম-কারে মায়ের আবাহনে কঠিন কিছু নেই।

লালা কেন মদ্যের প্রতীক? অতিশিশু এবং অতিবৃদ্ধরা বেসামাল থাকেন, লালা সামলাতে পারেন না। মানুষ বিবশ হলে লালাক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মদ্য অনুরূপভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীনতা বা অবশতার প্রতীক। সেজন্য লালা হল সূক্ষ্ম মদ্য।

7>★★★★★দ্বিতীয় ম-কার: মাংস হল জিহ্বা থেকে উদ্গাত মাতৃমন্ত্র।

জিহ্বা তো মাংসল অঙ্গ বটেই, সচেতন মাংস। জিহ্বা সেই মাংস যা মন্ত্রপূত, মন্ত্রপ্রবিষ্ট, মন্ত্রের উচ্চারক। মায়ের মন্ত্র উচ্চারণ তো সবাই করেন পূজার সময়, কাজেই দ্বিতীয় ম-কারে কঠিন কিছুই নেই।

8>★★★★★ তৃতীয় ম-কার: মৎস্য হল চক্ষু। চর্মচক্ষু বা মানসচক্ষু দিয়ে মায়ের মূর্তি দর্শন বা ধ্যান করাই মৎস্য উপচারে মায়ের পুজো। এটাও আমরা করে থাকি অবলীলায়।

মাছকে চক্ষুর সঙ্গে তুলনা করা হয় প্রাচীন কাল থেকেই। মীনাক্ষী হল মহাদেবীর অন্যতম নাম। মাছের মতোই আমাদের চক্ষু যেন চঞ্চলভাবে সাঁতার কাটে, ডুবে যায়, ভেসে ওঠে, বিহার করে, কামনার বড়শিতে আটকে যায়, আবার কখনও কখনও পরিযান করে এক জলরাশি থেকে আরেক জলরাশিতে। 

9>★★★★★ চতুর্থ ম-কার: মুদ্রা হল আমাদের শরীরের নানা রকম অঙ্গভঙ্গি এবং অবশ্যই যোগমুদ্রা।  নমস্কার করলে দুহাত জড়ো করে যা করাহয়, তাও মুদ্রা। মায়ের সামনে পদ্মাসনে উপবিষ্ট হয়ে পুজো করা, সেটাও মুদ্রা। অষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেও মুদ্রা। হরপ্পা সভ্যতায় নানারকম যোগমুদ্রা প্ৰচলিত ছিল, প্রত্ন প্রমাণ আছে।

10>★★★★★ পঞ্চম ম-কার: মৈথুন হল কুণ্ডলিনী সাধনা। কুণ্ডলিনী তত্ত্ব তন্ত্রের অন্যতম কেন্দ্রীয় তত্ত্ব। এবং দেহে মূলাধার চক্র থেকে সহস্রার চক্র পর্যন্ত কুণ্ডলিনী গমন করলে সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে চেতনা/পুরুষতত্ত্ব/●কনশাসনেসের মৈথুন ঘটে।


●(কনশাসনেস অর্থাৎ চেতনা মনের একটি ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য যাকে আরও অনেকগুলি মানসিক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি হিসেবে গণ্য করা হয়, যেমন আত্মমাত্রিকতা, আত্মচেতনা, অনুভূতিশীলতা, পৃথকীকরণ ক্ষমতা, এবং নিজের সত্তা ও আশেপাশের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবনের ক্ষমতা।)

সেই কারণেই পঞ্চ ম-কার তন্ত্রের বলিষ্ঠ বস্তুনিষ্ঠতার প্রতীক। স্থূল হোক বা সূক্ষ্ম, পঞ্চ ম-কার আমাদের বস্তুজগৎ থেকে উৎপন্ন, সংশ্লিষ্ট, সম্পৃক্ত ভাব।

 "মা" জগদকারণ। তিনিই বিশ্বচরাচর। তাই জীব ও জড়, ভাব ও বস্তু, দেহ এবং চেতনা আলাদা নয়। পঞ্চ ম-কার সেই শিক্ষা দেয়।

মা রূপে সেই অব্যক্ত প্রকৃতির ধ্যান, আবাহন ,ও আরাধনায় ম অক্ষরের এত প্রাবল্য।

[★★■★★  ]-------

 সূক্ষ্ম পঞ্চ ম-কার সাধনার সবথেকে আশ্চর্য বিষয় হলো  মায়ের পুজো আসলে নিজেই নিজের দেহে করতে হয়। অর্থাৎ নিজেই, নিজেকে পুজো করা।

মা আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত আছেন। স্থূল পঞ্চ ম-কার বাহ্যিক। কিন্তু সূক্ষ্ম পঞ্চ ম-কার আসলে আমাদের দেহকে ব্যবহার করেই মায়ের পুজো। সেজন্য পঞ্চ ম-কারের এই সূক্ষ্ম অর্থে লালা (মদ্য), জিভ (মাংস) চোখ (মৎস্য), সমগ্র শরীর (মুদ্রা) এবং কুণ্ডলিনী (মৈথুন) সহযোগে মাতৃকার ধ্যান আসলে আমাদের দেহ মন্দিরেই মায়ের পুজো। এবং মায়ের ভক্ত মাত্রেই অনায়াসে এই পুজোর অধিকারী। 

এই যে একটা ধারণা আছে যে বামাচার মানেই হল দুরূহ, অতি গুহ্য, কেবলমাত্র সংসারত্যাগী,  তান্ত্রিকদেরই অধিকার  – 

বামাচার। এটা একেবারেইঠিক নয়। 

স্থূল বামাচার সাধকের কৃত কর্মে হয়তো অসামাজিক হতে পারে, কিন্তু সূক্ষ্ম বামাচার সকলের জন্যই সহজ ও ঋজুপথে মাতৃসাধনা সুগম করে। 

সেই কারণে মায়ের সন্তান মাত্রেই বামাচারে মা বামাকালীর পুজো করতে পারেন। বরং সূক্ষ্ম বামাচার, সূক্ষ্ম পঞ্চ ম-কারেই মায়ের পুজো অনেক বেশি তদ্গত ও তন্নিষ্ঠ হয়, কারণ এক্ষেত্রে দেহমন্দিরেই মায়ের ঐশ্বর্যের আবাহন ও উদযাপন হয়, বাহ্যিক আড়ম্বর ছাড়া।

    <----আদ্যনাথ রায় চৌধুরী---->

             0/0/2009

===========================