Monday, January 27, 2025

10>aith 46>||তন্ত্র আর কিছু কথা ||(1+2)

  10>aith 46>||তন্ত্র আর কিছু কথা  ||(1+2)

           Part (1)

            <-----আদ্যনাথ----->

 সেদিন দেখলাম এক সাধু সাধনায় বিভোর। 

মধ্যপ্রদেশের  এমন শুষ্ক জঙ্গলে 

যেখানে শুধুই পলাশ ও মহুয়ার জঙ্গল ,

কাছে ধারে অন্তত 5/7 মাইলের মধ্যে কোন জনবসতি নাই। জঙ্গলে তেমন কোন ফলের গাছও নাই কেবল দুই একটি আমলকি গাছ দেখাযায় তাও সংখ্যায় অতি কম।

এমন জায়গাতে ধ্যানমগ্ন সাধুকে দেখে বেশ অবাক হলাম। 

আমি জিপ নিয়ে যাচ্ছিলাম চম্পা থেকে বিলাসপুরের দিকে ।

ইচ্ছা হোল ওই জঙ্গলের ভিতরের মন্দিরটা একটু দেখে যাই, বহুদিন আগে একবার এসেছিলাম তাই ইচ্ছা হোল,  জিপ ঘুরিয়ে দিলাম জঙ্গলের দিকে  হঠাৎ দেখি ওই মন্দিরের একটু আগেই পাকদন্ডির ধারে জঙ্গলের মধ্যে একটি ঢিবির উপরে বসে আছেন এক সাধু। ইচ্ছা হোল একটু কথা বলি কিন্তু প্রায় আধা ঘন্টা দাঁড়িয়েও সাধুর ধ্যান ভাঙলো না। অগত্যা আজকের মতন মনের ইচ্ছা মনে চেপে রেখে রওনা দিলাম। আরএকটু এগিয়ে গিয়েই সেই মন্দিরটি  দেখলাম।

এমন সুন্দর কারুকার্য করা মন্দির  ভিতরে কোন দেবতা আছে জানিনা কারন আজও দেখলাম মন্দিরের গেট বন্ধ।

তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কোন শিব মন্দিরই হবে।

তবে মন্দিরটির সম্পুর্ন দেওয়ালে সেই পুরীর মন্দিরের মতন স্ত্রী-পুরুষের যৌনমিলনের মূর্তি । 

গ্রামটির নাম ভুলে গেছি তবে মবেহয় ছিন্নর।

একটু দাঁড়ালাম যদি কোন মানুষের দেখা পাই তো মন্দিরটির বিষয়ে যদি কিছু জানতে পারি।

এই জঙ্গলের আমাদের ক্যাম্প আছে দুইটি  সেও অনেক দূরে দূরে।

আমি ড্রিলিং এর কোর সেম্পেল নিয়ে যাচ্ছিলাম বিলাসপুরের  অফিসে ।



(আমি যে ছিন্নর গ্রামের কথা বলছি  সেটি

কিন্তু মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট জেলার চিন্নর  জেলা জিআই ট্যাগ পাওয়া চিন্নর নয়।

চিন্নর বিখ্যাত এক প্রকার চালের জন্য।

 এটি একটি স্বাদু, মিষ্টি, এবং সামান্য আঠালো চাল। রান্নার পরেও এটি জল ধরে রাখে। চিন্নর চাল থেকে তৈরি খির বালাঘাটের মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয়। )


কিন্তু সেই সাধুর তাঁর ধ্যান থেকে জাগলেন না। 

আমার কোরস্যাম্পেল গুলি অফিসে পৌঁছতে হবে তাই একটু তারা আছে।

সেই কারণে আর অপেক্ষা না করে চলেগেলাম।

কিন্তু মনে একটু খটকা লাগলো ঐসাধুর জন্য । তাই ফেরার পথে তখন সন্ধ্যে 6টা হবে জঙ্গলে অন্ধকার নেমে আসছে, আমি আবার গেলাম ওই সাধুকে দেখতে। গিয়ে দেখি সাধু কিছু কাঠ কুড়োচ্ছেন। আমি আযাচক হয়ে ওনাকে কাঠ কুড়োতে একটু সাহায্য করলাম। সাধু আমাকে আশীর্বাদ করলেন। আমি কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতেই উনি মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বললেন। আমি অবাক হয়ে চুপ থাকলাম।

তারপরে সাধুটি ইশারায় আমাকে ওনার সাথে যেতে বললেন। আমি ওনার কথামতন ওনার পিছু পিছু এগিয়ে চললাম।

জঙ্গলের ভিতর গিয়ে দেখি ছোট্ট একটি কুঠি , সাধু কুঠিরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে একটি কাঠি দিয়ে মেখেতে হিন্দিতে লিখলেন।

"अभी तुम निकल जाओ। 

बादमे भेट करना अमरकंटक में।"

এমন কথা লিখেই উনি আমাকে যেন তাড়িয়ে দিতে পারলেই বাঁচে, এমন ভাব করে প্রায় দূর দূর করে আমাকে তাড়িয়েই দিয়ে ছিলো সেদিন।

এর কিছু দিন পরে আমি গিয়েছিলাম এমরকন্টকে সেই সাধুর খোঁজ করতে।

এর আগেও আমি অমর কন্টকে এসেছিলাম তাই কিছু মানুষ ও সাধুর সাথে পরিচয় আছে।

আমি সকলকেই ওই সাধুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে কোন খবর পেলাম না।

সেবার আমি ছয় দিন ছিলাম অমর কন্টকে, তৃতীয় দিনে গেলাম

নর্মদা মন্দির থেকে 4-5 কিলোমিটার দূরে শোনমূঢ়াতে।

এখানে শোন ও ভদ্র  নদীর উত্‍পত্তিস্থলে গড়ে উঠেছে দেবী শোনাক্ষীর মন্দির, যা একান্ন সতীপীঠের অন্যতম পীঠ। 

ব্রহ্মার মানস পুত্র শোন।ব্রহ্মার চোখের জল থেকেই শোন নদীর উৎপত্তি।

শোনের উদ্‌গম স্থলের অনতিদূরে ভদ্র নদীর উৎস স্থান। এখান থেকেই শোন ও ভদ্র এক হয়ে জল প্রপাতের সৃষ্টি করেছে। সেই প্রপাত দেখবার মতো। এরপর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে শোন বিহার প্রদেশে শোনপুরে গিয়ে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে।

এখানে শোন ভদ্র কুণ্ডের  কাছে যেতেই দেখা হোল সেই সাধুর সঙ্গে।

আমাকে দেখেই সাধু একটু হেসে বললো 'কি মনে পড়েছে?"

আমি ওনার মুখে বাংলা কথা শুনে খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। উনি নিজেই বললেন কি হোল! আরে আমি বাংলা জানি। 

আয় আমার কুঠিতে আয়, এইবলে উনি আমাকে যে কুঠিতে নিয়ে গেলেন সেই কুঠি আমার চেনা।

আমি বললাম বাবা এখানে তো একদন্ডী বাবা থাকতেন! 

সাধু বললেন হ্যাঁ গুরুজী নাসিক গেছেন কুম্ভ স্নানে এখনো ফেরেরনি , উনি ফিরলেই আমি যাবো হরিদ্বার।

এই স্থানেই আমার সাধনার স্থান।

এখানেই আমি শবসাধনা কিরেছি গুরুজীর উপস্থিতিতে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে শবসাধনা সেতো তাড়াপীঠে হয় দেখেছি।

মরা লাশের পিঠে ত্রিশূল পুঁতে যজ্ঞ কুন্ড জ্বালিয়ে। রাত ভর সেকি কান্ড।

সেবার এমন সাধনা দেখে ভিষিন অবাক হয়েছিলাম। তা এই এমরকন্টকেও শবসাধনা হয় জানতাম না।

সাধু বললেন হ্যাঁ শবসাধনা ভীষণ কঠিন সাধনা। অমরকন্টের এই শোনমূঢ়ার

দেবী শোনাক্ষীর মন্দির, যা এক সতিপিঠ।

আর সতিপিঠ মানেই সিদ্ধ স্থান।

এখানে সকল সাধনার উৎকৃষ্ট স্থান।

আমি বেশ উৎসাহ অনুভব করলাম এবং শবসাধনার বিষয়ে জানবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম সাধু মহারাজের কাছে (ওনার নাম সিদ্ধান্তনন্দ)। এর পরে আরও তিন দিন ওই শোনমূঢ়ায় থেকে সাধুজীর কাছে 

তন্ত্র সাধনার অনেক কথাই জেনেছিলাম।

আজ সেই সাধু কাছে শোনা তন্ত্র সাধনা নিয়েই লিখছি--------(যেটুকু যা বুঝতে পেরেছিলাম ও যা কিছু মনে আছে )

শুরু কিরেছি  "শব সাধনা" নিয়ে কিছু লিখতে------


  "সাহসে যে দুঃখদৈন্য চায়

   মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে।

    কালনৃত্য করে উপভোগ

    মাতৃরূপা তারি কাছে আসে ।"

                  ( বিবেকানন্দ)

এমন কথাই তন্ত্রের মূল কথা ।

সাধুজীর কথায় কালী,করালিনীর উপাসনা , ভীমার পূজা, রুদ্রানীর আবাহন

প্রভৃতি----দুর্বল হৃদয়ে কাজ নয়।

সাহসী শক্তিমানের একান্ত আত্মবিশ্বাসের 

উপর নির্ভর করে অসীম সাহসেরসঙ্গে এই সাধনা করতে হয়।

আসলে অমোঘবীর্যে প্রতিষ্ঠা যে সাধনা সেখানে হৃদয়ের সকল বাসনা, কামনাকে নির্মূল করে সাধকের হৃদয়কে শ্মশান করে তোলে এবং সেই উন্মুক্ত হৃদয়ে মহা আনন্দে সর্বসুন্দরের অধিকারী  শ্যামাসুন্দরীর নৃত্য হবে। আর এভাবেই তন্ত্র সাধনা হয়।


তন্ত্র সম্বন্ধে বলা হয়---

" তন্ত্র" শব্দটি ( 'তন্' ধাতু নিষ্পন্ন যার অর্থ 'বিস্তার')

তন্ ধাতুর উত্তর উনাদি প্রত্যয় ষ্ট্রন্ প্রয়োগ করে ব্যুৎপন্ন হয়েছে। তন্' ধাতুর অর্থ 'বিস্তার'। 

বিশেষ বিশেষ পন্ডির যাঁরা তন্ত্র সাধনা বিষয়ে  জ্ঞান রাখেন যেমন বাচস্পতি, আনন্দগিরি এনদের  মতে তন্ত্রি ধাতু থেকে তন্ত্র শব্দ ব্যুৎপন্ন। তন্ত্রি ধাতুর অর্থ ব্যুৎপাদন বা জ্ঞান। 

এভাবেই দেখা যায় যে তন্ত্রি ধাতুরও অর্থ বিস্তার রূপে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। 

সুতরাং তন্ত্র শব্দের দ্বারা যে কোন বিস্তারিত আলোচনা বুঝানো যায়।



সেইজন্য দেখা যায় প্ৰাচীন কালে যাগ, যজ্ঞ, ক্রিয়া, তত্ত্ব, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় বুঝানোর জন্য তন্ত্র শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।

এভাবেই সংখ্যা দর্শনের গ্রন্থাদির নাম ছিল 

ষষ্টিতন্ত্রশাস্ত্র, ন্যায়তন্ত্র,ধর্মতন্ত্র,ব্রহ্মতন্ত্র,

যোগতন্ত্র,আয়ুর্বেদতন্ত্র প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়।

কিন্তু কালক্রমে তন্ত্র শব্দের সঙ্কীর্ণতর ক্ষেত্রে প্রয়োগ দেখা যায়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে তন্ত্রের(4 )চারটি অংশ::---

●1>জ্ঞান--- অর্থাৎ দার্শনিক মতবাদ, 

বীজাদির শক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান, মন্ত্রশাস্ত্র।

●2> যোগ----অর্থাৎ ধ্যানধারণাদির বর্ণন ও বিবিধ সিদ্ধিলাভের জন্য মায়াযোগ।

●3>ক্রিয়া---মূর্তি--মন্দিরাদির 

নির্মাণবিষয়ক  আলোচনা এবং

●4>চর্যা---- অর্থাৎ আচার-- ব্যবহার, উৎসব ব্রত  প্রভৃতির  আলোচনা।


এ-হেন আলোচনা থেকে অতি সহজেই বোঝাযায় যে তন্ত্রশাস্ত্র এক বিশাল সমন্বয় - প্রচেষ্টা। 

"বহু ভাবধারার প্রবাহ ভারতের জীবনে বিভিন্ন অববাহিকাকে অবলম্বন করে এসেছিল। তারই সমীকরণের ফল তন্ত্রশাস্ত্র।"

এমনটাও জানা যায় যে -----

"বেদের কর্মকান্ড ,মীমাংসা,বেদান্ত, সংখ্যা,

যোগ , বৈষ্ণব মতবাদ, চরক ও সুশ্রুতের চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি সকল কিছুই তন্ত্রের মতবাদের অঙ্গরূপে তন্ত্রের মধ্যে বর্তমান।"


এছাড়াও তন্ত্র শাস্ত্রের বিশেষ অংশ যা 

বামাচার নামে প্রখ্যাত তা আর্য ও অনার্য ভাবধারার সংমিশ্রণ।


[[[  তন্ত্র শাস্ত্রের ইতিহাস খুঁজতে গেলে 

পাওয়ায় যে----

 বিবেকানন্দ সহ বহু মনীষীদের মতে 

বৌদ্ধরাই তন্ত্রের শ্রষ্টা।

এক সময়ে ভগবান তথাগতর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্ঘে নারীজাতির স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কঠিন বিধিনিষেধের দ্বারা সঙ্ঘে স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশাকে নিয়ন্ত্রিতও করেছিলেন।

তথাপি সময়ে নানা জাতিসমূহের অনৈতিক প্রথার সংমিশ্রনে নানা মতের উদ্ভব ও স্ত্রী --পুরুষের সাহচর্যে  নিশাকালে নানারূপ গুহ্যসাধনার ব্যবস্থা করা হয়।

এভাবেই বৌদ্ধগ্রন্থ গুহ্যসমাজতন্ত্রে বামাচার তন্ত্রের সৃষ্টি হয়।

প্রজ্ঞাভিষেকে এর উল্লেখ আছে।

প্রজ্ঞাভিষেকের মূলকথা শক্তিগ্রহণ।

গুরু, শিষ্যের অভিলষীতা,সুন্দরী ,

যোগপারদর্শিনী শক্তির সঙ্গে শিষ্যকে মিলিত করবেন। এই বিদ্যাগ্রহণ বা 

শক্তিগ্রহণ ব্যতিরেকে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির অন্য উপায় নাই। এই শক্তি আপরিত্যাজ্যা।

এই শক্তিগ্রহণের নাম বিদ্যাব্রত।

এরপরে যখন বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে হিন্দুধবর্মের সঙ্গে মিলিত হয় তখন সকল বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচার সনুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অনুপ্ৰবিষ্ট হয়ে হিন্দুতন্ত্রের  সৃষ্টি হয়।

হিন্দুতন্ত্র  যে বৌদ্ধোত্তর এবং বৌদ্ধতন্ত্র থেকে উদ্ভূত তা বহু মনীষী স্বীকার করেছেন।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন 

" আমার বিশ্বাস আমাদের মধ্যে প্রচলিত তন্ত্রের সৃষ্টি বৌদ্ধরাই করেছে।"

আসলে তন্ত্র হোল সমন্বয়-শাস্ত্র এবং এর যা পরমতত্ত্ব তা অদ্বৈত বেদান্তের তত্ত্ব থেকেই গ্রহীত।

তন্ত্রমতে নির্গুণ ব্রহ্মই মায়াসংযুক্ত হয়ে জগতের সৃষ্টি করেন। কিন্তু বেদান্তের মায়া 

"সদসদভ্যামনির্বচনীয়া"।

আর তন্ত্রের মায়া ব্রহ্মের সহিত অভিন্ন এবং সদ্রূপা। সুতরাং বেদান্তের জগৎ যে-অর্থে মিথ্যা তন্ত্রের জগৎ সেই অর্থে মিথ্যা নয়। ]]]

   <-------আদ্যনাথ রায় চৌধুরী-------->

============================

  তন্ত্র আর কিছু কথা  ||(2)

           Part (2)

            <-----আদ্যনাথ----->

★আসল কথা হোল শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের অবলম্বন করে শাক্ত মতবাদ এবং শক্তির পূজা প্রতিষ্ঠিত।

বলাহয় সাধকের হিতের জন্যই ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করা হয়। 

বাংলার তন্ত্রসাধক  কালীর সাধক ।

কালীর উপাসনা  বাঙালির একান্ত নিজের প্রাণের উপাসনা। তাইতো কালী মুর্তিকল্পনায় স্বয়ং শিব- শবরূপে কল্পনা----এ-হেন শিবতত্ত্ব--শিব যিনি অহম্ বোধে মগ্ন। আর মহাকালী--

--তিনি--শক্তিতত্ত্ব-- তিনি সর্বদা ক্রিয়াশীল

-- ক্রিয়াশক্তি--সৃষ্ট্যুন্মুখী--অর্থাৎ সৃষ্টির তরে উন্মুখ। তাঁর অন্তরে সৃষ্টির বীজ রয়েছে। অন্যান্য দেবীমূর্তির কল্পনাতেও এই শিব--শক্তিতত্বেরই প্রকাশ।

এই শক্তি তত্ত্ব এর মূলেও রয়েছে বেদ।

কারণ ঋগ্বেদের  দশম- মন্ডলে দেবী সূক্তে বলা আছে ---"আমার দ্বারাই লোক জীবিত আছে। অন্নগ্রহণ ও শ্রবণাদিও করছে।

আমাকে যে অবহেলা করে সে বিনষ্ট হয়। 

তুমি শ্রদ্ধাবান । এইজন্য তোমাকে বলছি।

দেবী ভগবতী মহামায়ার পূজা বাহ্যিক ও হতেপারে বা অন্তর ধ্যানজপাদিও হতে পারে।  

দেবীর গূঢ় রহস্য ব্যাখ্যা করা সে এক বিশাল কঠিন ব্যাপার ।দেবীর মন্ত্রাদির যে তত্ত্ব তাও ব্যাখ্যা করা অতি দুরূঢ় ব্যাপার, যা এই ছোট অবসরে সম্ভব নয়।

          

তবে এইটুকু আমাদের অবশ্যই জেনে রাখতে হবে যে দেবীর বাহ্যিকপূজার

আরালে  এবং বিভিন্ন মন্ত্রাদির ব্যবহারে সচেতন বিন্দু ,নাদ,ও বীজামন্ত্র অবলম্বন করে একটি বিরাট দার্শনিক পটভূমিকা আছে।

●মন্ত্র তন্ত্রের মন্ত্র সকল  নিরর্থক শব্দমাত্রই নয়।

তন্ত্র বলে যে, মানব দেহভান্ড ব্রহ্মাণ্ডেরই প্রতিরূপ। এই দেহে শিব-শক্তি আছেন।

পরম শিব সহস্রারে এবং শক্তি কুন্ডলিনীরূপে  মূলাধারে। অবরোহক্রমে।

এই জগতের সৃষ্টি।

অবরোহক্রমে সাধক কুন্ডলিনীর সঙ্গে পরম শিবের মিলন করতে পারলেই মোক্ষ লাভ হয়। এই মিলনসাধনের জন্য তন্ত্রে পূজা, ধ্যান, মন্ত্রজপ,হোম, দীক্ষা প্রভৃতি নির্দিষ্ট হয়েছে।

এই বিষয়ে আর একটি বিষয়ের হল;--

তন্ত্র আর্য ও আর্যেতর ভাবধারার সংমিশ্রণ।

এর ফলে তন্ত্রের মধ্যে বৈদিক ও অবৈদিক আচার মিশ্রিতভাবে আছে। তন্ত্রে সাধকের জন্য যেসকল আচার  নির্দিষ্ট আছে তা বিশেষ তন্ত্রের মতে সাতটি---

1>● বেদচার, 

2>●বৈষ্ণবাচার,

3>●শৈবাচার,

4>●দক্ষিণাচার,

5>●বামাচার,

6>●সিদ্ধান্তাচার,

7>●কৌলাচার।

এগুলির মধ্যে প্রথম চারটি অর্থাৎ

বেদচার, বৈষ্ণবাচার,শৈবাচার,দক্ষিণাচার,

এরা বেদপর এবং শেষ তিনটি--

বামাচার,সিদ্ধান্তাচার,কৌলাচার, এগুলির

আচার অবৈদিক ভাবপূর্ন।

সাধারনত প্রথম চারটি আচার হিন্দুধর্মের -- মর্মে মর্মে অনুপ্ৰবিষ্ট হয়ে বাঙালীর ধর্মসাধনাকে প্রাণবন্ত করেছে। তত্ত্বের সঙ্গে ক্রিয়ার সহযোগে একটি সাধনার সহজ পথের আবিষ্কার করেছে।

বাঙালী জাতির পূজা দীক্ষা, ব্রত, নিয়ম প্রভৃতি সকল বিষয়ই তন্ত্রের এইসকল আচার দ্বারা পরিচালিত।

কিন্তু বামাচার প্রভৃতি ---যা গোপনে অনুশিষ্ঠ প্ৰক্রিয়াদির সহযোগে অনুষ্ঠিত

হয়--তা অনৈতিক ভিত্তিভূমির উপরে আস্তৃত (বিস্তৃত বা প্রসারিত)। এইসকল আচারে পঞ্চমকারের অনুষ্ঠানে মদ্য,মাংস,মৎস্য, মুদ্রা, এবং স্বকীয়া বা পরকীয়া স্ত্রীগ্রহণ করা হয়।

অবশ্য তন্ত্রে অধিকারভেদে  তিনটি ভাবকে আশ্রয় করার কথা আছে।

★দিব্যভাব, ★<বীরভাব, ★পশুভাব।

দিব্যভাবের যাঁরা মানুষ তাঁরা উচ্চস্তরের লোক। 

তাঁদের পক্ষে মদ্য অর্থে সহস্রার ক্ষরিত সুধাধারা, 

কাম ক্রোধ প্রভৃতি রিপুকে ছেদনপূর্বক নির্বিষয়তালাভই মাংসগ্রহণ, 

অহঙ্কার দম্ভ প্রভৃতিকে বশীভূত করাই মৎসভক্ষণ, 

আশা তৃষ্ণা প্রভৃতি অষ্টমুদ্রাকে দমন করাই মুদ্রা গ্রহণ এবং 

ইড়াপিঙ্গলা- বাহিত বায়ুর সুষুম্নাতে সংযোগই স্ত্রীগ্রহণ ।


যাঁরা পশু ভাবে-- স্থিত তাঁদের পক্ষে সম্বিদা, গুঁড়ার্দ্রক প্রভৃতি মদ্যের অনুকল্প, 

লবনার্দ্রক  মাংসানুকল্প, 

লবণতৈলাক্ত দগ্ধকুষ্মান্ড মৎসানুকল্প, ঘৃতে ভর্জিত মুগ প্রভৃতি বীজ মুদ্রাকল্প এবং রক্তচন্দনানুলিপ্ত অপরাজিতা এবং করবী পুষ্পের সংযোগেই পঞ্চম মকারানুকল্প।


বীরভাবে কিন্তু মুখ্য পঞ্চতত্ত্বের ব্যবহার আবশ্যিক এবং বামাচারীদের মতে কলিযুগে পশুভাব প্রতিষিদ্ধ । 

কাজেই যেহেতু দিব্যভাবের সাধক দুষ্প্রাপ্য সেই জন্য অধিকাংশ তান্ত্রীকেরই বীরভাবে মুখ্য পঞ্চতত্ত্ব গ্রহণ করেই সাধন করা উচিত---বামাচারীদের মতে। 


এই কারনেই বামাচার বাংলার সমাজে গভীরভাবে আত্মপ্রবেশ করেছে। 


বীরভাবের বামাচার  সাধবের অবশ্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমি আছে। যেসকল লোক সহজাত প্ৰবৃত্তির অবদমনহেতু মানষিক - আপচারসম্পন্ন

(Psycho-pathological) তাদের মানবগ্রন্থির মোচনের জন্য বা সংস্কারের উদ্গতির জন্য বীরভাবের সাধনা ফলদায়ক হতে পারে। 


ভোগের পথে মানুষের মনকে ধীরে ধীরে কিভাবে ঈশ্বরাভিমুখী করা যায় সেই অসাধ্য সাধনেই বীরভাবের প্রচেষ্টা। রূপরস মুগ্ধ অস্বাভাবিক মনোবিশিষ্ঠ  মানুষকে সাহায্য করাই বীরভাবের উদ্দেশ্য। 


সুস্থিমনঃসম্পন্ন  স্বাভাবিকবৃত্তিবিশিষ্ট  মানবের জন্য কিন্তু এপথ নয়। এপথে  

শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের কথায় --"পায়খানার পথ"। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন ::--

"যে জঘন্য বামাচার তোমাদের দেশকে নষ্ট করে ফেলেছে অবিলম্বে তা ত্যাগ কর । তোমরা ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান দেখেনি। দেশের পূর্বসঞ্চিত জ্ঞানের যতই বড়াই কর না কেন, যখন আমি দেখি আমাদের সমাজে বামাচার কী ভয়ানকরূপে প্রবেশ করছে, তখন উহা আমার অতি  ঘৃণিত নরকতুল্য স্থান বলে বোধ হয়।

এই বামাচার সম্প্রদায় আমাদের বাংলাদেশের সমাজকে ছেয়ে ফেলেছে আর রাত্রে বীভৎস ব্যাভিচারে লিপ্ত থাকে তারাই দিনেরবেলা উচ্চকন্ঠে আচারের কথা বলে ।"


সুতরাং এই বামাচার প্রভৃতি কুৎসিত ব্যাপার সযত্নে পরিহার করে তন্ত্রের মধ্যে যাকিছু ভালো জিনিষ আছে তা গ্রহণ করতে হবে। তন্ত্রের সবচেয়ে বড় কথা  মাতৃভাবে দেবীর উপাসনা এবং এই উপাসনা করতে হবে নির্ভয় হয়ে। অভয়প্রতিষ্ঠ সাধকই যথার্থ বীরসাধক।

মদ্য মাংসাদিসেবী তথাকথিত 

বীরভাবালম্বী বীরসাধক নয়। এই বীরসাধক ছিলেন বীরেশ্বর বিবেকানন্দ যিনি ভীষণকে ভিষনতার জন্যই পূজা করতে চেয়েছিলেন, যিনি উপদেশ করেছিলেন তাঁর শিষ্যকে যে, যখন মায়ের কাছে প্রার্থনা জবাবে তখন "মনে রেখো তিনি যেন তোমার প্রার্থনা শুনতে বাধ্য হন। মায়ের কাছে  কোন আর্তভাব যেন প্রকাশ না পায়। স্মরণ রেখো।" 


সত্য এই তো যথার্থ বীরভাবের কথা।

আমরা নানান স্থানে নানা ভাবে মায়ের পূজা করি। কিন্তু প্রকৃত ফল কিছু পাই কি?  

অঙ্গহীন হলে বা শ্রদ্ধার  অভাব হলে পূজার ফলাফল হয় না, বিপরীত ফলও ঘটতে পারে। কজেই ঠিক ভাবে পূজা 

করাই উচিত আর এই সঠিক ভাবে  পূজা

করতে হলে অভয়প্রতিষ্ঠি হয়েই করতে হবে। আর তখনই মায়ের অমোঘ আশীর্বাদ আমাদের শিরে বর্ষিত হবে।

স্বামী সারদানন্দের "ভারতে শক্তিপূজা" থেকে এই বিষয়ে একটু তুলে ধরেই আমি আমার লেখা শেষ করছি:-------

  " অন্য দেশে মা শত হস্তে ধনধান্য ঢালিয়া  দিতেছেন। দেখিয়া ঈর্ষায় তোমার অন্তস্থল জ্বলিয়া উঠে। তাহাদের হৃষ্ট-পুষ্ট  সন্তানসকলের প্রফুল্ল মুখকমলের সহিত  ক্ষুৎক্ষামকণ্ঠ, আচ্ছাদনবিরহিত, রোগে জর্জরিত তোমর সন্তানসকলের তুলনা করিয়া তুমি জগদম্বাকেই শত দোষে দোষী কর। অন্যের পদঘাতপীড়িত  হইয়া তুমি অদৃষ্টকে শতবার ধিক্কার দিয়ে থাক--- কিন্তু দোষ কার?

দেখিতেছ না , তাহারা অজ্ঞান সমরে সামর্থ প্রকাশ করিয়াই বড় হইয়াছে--- আর তুমি সহস্র বৎসর অজ্ঞানকে হৃদয়ে অতি যত্নে পোষণ করিয়া নীরবে , নিশ্চিন্ত আছ?  উহারা বিদ্যরূপিনী শক্তির পূজার অদম্য উৎসাহে কষ্ট সহিয়াছে , অজস্র হৃদয়ের রুধির ব্যায় করিয়াছে, দশের  কল্যাণের জন্য আত্মবলি দিয়া দেবীকে প্রসন্ন করিয়াছে-- আর তুমি অবিদ্যাসেবায় যথাসর্বস্ব পণ করিয়া ক্ষুদ্র স্বার্থসুখ লইয়া বসিয়া আছ। জগন্মাতা তোমায় দিবেন কেন? 

শাস্ত্র যে তোমায় বারবার বলিতেছেন, তিনি বলিপ্রিয়া, রুধির প্রিয়া। দেবীর ঐ ভাব যে তাঁহার ধ্যানমন্ত্রে রহিয়াছে। ঐ শুন, ভারতের তন্ত্রকার তোমায় কি ভাবে শক্তির ধ্যান করিতে বলিতেছেন---


"ওঁ শবারুঢ়াং মহাভীমাং ঘোরদংস্ট্রাং বরপ্রদাম্।

হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্ত্তৃকাকরাম্।।

মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহু। 

চতুর্ব্বাহুযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ।।"

প্রতিকার্যে  মহাশ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া স্বার্থসূখ ত্যাগ , আত্মবলিদানে তাঁহার তর্পণ কর। তাঁহাকে প্রশ্ননা কর, দেখিবে শক্তিরূপিনী জগদম্বা  তোমার প্রতি ফিরিয়া চাহিবেন। তোমার নয়নে দীপ্তি, বাহুতে বল, হৃদয়ে তেজ, অন্তরে অদম্য উৎসাহরূপে প্রকাশিত হইবেন। দেখিবে  জগন্মাতার নিত্য সহচরীদল---বুদ্ধি, লজ্জা,ধৃতি, মেধা, প্রভৃতি -- আবার তোমার উপর প্রসন্না হইয়া প্রতি কার্যে তোমার সহায়তা 

করিবেন।"

 <-------আদ্যনাথ রায় চৌধুরী-------->

============================


No comments:

Post a Comment